নীল বিদ্রোহ

বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে একটি অতি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দের নীল বিদ্রোহ।ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতে আগত নীলকর সাহেবরা বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে নীলের লাভজনক ব্যবসা শুরু করেন। তাদের শোষণ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার নীল চাষিরা সংঘবদ্ধভাবে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তা ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

নীল বিদ্রোহের কারণ-

  • দাদন প্রথাঃনিরক্ষর ও দরিদ্র কৃষকদের মাত্র ২ টাকা দাদন দিয়ে তার সর্বোৎকৃষ্ট জমিতে নীলকর সাহেবরা নীলচাষে বাধ্য করতেন। ছলে, বলে, কৌশলে নীলকর সাহেবরা এমন সব চুক্তিপত্র তৈরি করতেন, যাতে নীলচাষী সারা জীবন তাদের ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতো। স্বভাবতই এই ব্যবস্থা নীল চাষীদের ক্ষুব্ধ করেছিল।
  • কৃষকদের ক্ষতি-নীলচাষের কৃষকের যে খরচ হতো উৎপাদিত নীল বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচও উঠত না। জমিতে ধান, তামাক, কলাই ও অন্যান্য শস্যের চাষ অধিকতর লাভজনক হলেও অগ্রিম দাদন নেওয়ার ফলে কৃষকদের ওইসব ফসল চাষ করা অধিকার ছিল না। বিশেষত ধান চাষ বন্ধ হওয়ার ফলে কৃষকের ঘরে এক সময় তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ফলস্বরূপ নিরন্ন কৃষকেরা শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
  • নীলকর সাহেবদের অত্যাচার-নীল চাষে বাধ্য করার জন্য বা উপযুক্ত পরিমাণে নীল আদায়ের জন্য নীলকর সাহেবরা দরিদ্র নীল চাষীদের উপর অত্যাচার চালাতো। নীলকর সাহেবদের লাঠিয়াল বাহিনী চাষীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত, তাদের স্ত্রী-কন্যাদের অপহরণ ও অসম্মান করত। চাষীদের উপর দৈহিক অত্যাচার চালানো হতো। দরিদ্র কৃষকরা ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের সম্পন্ন কৃষক, জমিদার বা সাধারণ মানুষ কেউই তাদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেতো না।এইসব অত্যাচারের হাত থেকে নীলচাষিরা বিদ্রোহে সামিল হয়েছিল।
  • বিচারকদের অবিচার-নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদে আদালতে গিয়েও কোন লাভ হতো না।নীলচাষিদের কপালে জুটতো শুধুই লাঞ্ছনা। কারণ দেশের আইন কানুন নীলচাষিদের স্বার্থেই রচিত হয়েছিল।পুলিশ ও বিচারপতিরাও ছিলেন নীলকর সাহেবদের সহযোগী। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নীলকর সাহেবরা নিজেরাই ছিলেন বিচারক।এই অবিচারের বিরুদ্ধে নীলচাষীরা বিদ্রোহের পথ বেছে নিয়েছিল।
  • পঞ্চম আইন-নীলকর সাহেবদের চাপে পড়ে ব্রিটিশ সরকার পঞ্চম আইন পাস করে (1830 খ্রিস্টাব্দে) ঘোষণা করে যে কোন কৃষক দাদন নিয়ে নীল চাষ না করলে নীলকর সাহেবরা কৃষকদের কয়েদ করতে ও তাদের অস্থায়ী সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। এই আইন পাসের ফলে নীল চাষীদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং নীলকর সাহেবদের বেআইনি ও হিংসাত্মক কাজের ফলে কৃষকরা প্রায় ভূমিদাসে পরিণত হয়। এই কারণে পঞ্চম আইন নীলচাষীদের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।

নীল বিদ্রোহের সূচনা ও বিস্তার

  • নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে 1859 খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে নদিয়ার চৌগাছা গ্রামে সর্বপ্রথম নীল বিদ্রোহের সূচনা হয়।ক্রমে বিপ্লবের আগুন সমগ্র নদীয়া, যশোর, খুলনা, পাবনা, ফরিদপুর, রাজশাহী, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, বারাসাত প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় 60 লক্ষ কৃষক বর্শা, তরবারি, বাঁশের লাঠি ও ঢাল নিয়ে এই বিদ্রোহে সামিল হয়।
  • এই বিদ্রোহের প্রথম পর্যায়ে নীলচাষরা নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারের কথা জানিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষকে প্রতিকারের জন্য আবেদন জানায়।
  • এতেও কোনো ফল না হওয়ায় বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়ে নীলচাষীরা নীল চাষের জন্য দাদন নিতে অস্বীকার করে এবং নীল চাষ বয়কট করে।
  • তাদের বলপূর্বক নীলচাষে বাধ্য করা শুরু হলে বিদ্রোহের তৃতীয় পর্যায়ে নীলচাষীরা সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর নীলকর সাহেবরা নীল চাষীদের উপর আক্রমণ করলে নীলচাষীরাও প্রতি আক্রমণের পথ ধরে।

নীল বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ

  • নদীয়ার বিষ্ণুচরন বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস, আসননগরের মেঘাই সর্দার, খুলনার কাদের মোল্লা, পাবনার মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, মালদহের রফিক মন্ডল, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার এবং নড়াইলের জমিদার রাম রতন মল্লিক, চন্ডিপুরের জমিদার শ্রীহরি রায়, রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পাল চৌধুরী, সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য প্রমুখ নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
  • দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরন বিশ্বাসকে ইংল্যান্ডের কৃষক বিদ্রোহের নেতার সঙ্গে তুলনা করে 'বাংলার ওয়াট টাইলার' বলে অভিহিত করা হয়
  • নীল বিদ্রোহে নেতৃত্বদান করার জন্য রাম রতন মল্লিককে 'বাংলার নানাসাহেব' বলে অভিহিত করা হয়।

শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ভূমিকা-

  • 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নীল চাষীদের পক্ষে কলম ধরেন এবং প্রতিটি নীলকুঠি বন্ধ করা তথা উঠিয়ে দেয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেন।
  • 'ক্যালকাটা রিভিউ' পত্রিকায় নীলকরদের "ভাগ্যান্বেষী ও দুর্বৃত্ত শ্রেণীর মানুষ" বলে অভিহিত করা হয়।
  • দীনবন্ধু মিত্র তাঁর 'নীলদর্পণ' নাটক নীল চাষীদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের মর্মস্পর্শী কাহিনী তুলে ধরেন।
  • মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নীলদর্পণ নাটক ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং এটি রেভারেন্ড জেমস লং প্রকাশ করলে লং সাহেবের এক মাস কারাদণ্ড ও ১000 টাকা জরিমানা হয়। জমিদার কালিপ্রসন্ন সিংহ নিজে ঐ টাকা জমা দেন।
  • গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শিশির কুমার ঘোষ, কিশোরী চাঁদ মিত্র, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রমূখ শিক্ষিত মানুষেরা নীলচাষীদের নানাভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহিত করেন।

নীল বিদ্রোহের অবসান-

  • সমগ্র বাংলা জুড়ে নীল বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়লে বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার উপদ্রুত অঞ্চলে পুলিশ ও মিলিটারি পাঠায়। যশোর টু নদীয়া জেলায় দুটি ছোট ছোট ছোট রণতরীও পাঠানো হয়।
  • কিন্তু তা সত্বেও বিদ্রোহ দমন করা না গেলে একাদশ আইন পাশ করে সরকার ঘোষণা করেন যে নীলকর সাহেবদের কাছ থেকে দাদন নিয়েছে এমন কৃষক নীলচাষ না করলে তাদের বিঘা প্রতি দশ টাকা জরিমানা দিতে হবে এবং তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
  • তা সত্ত্বেও নীল চাষিরা বিদ্রোহের পথ পরিত্যাগ না করলে বিদ্রোহের ব্যাপকতা, গভীরতা ও বিদ্রোহের প্রতি প্রবল জন সমর্থনের কথা চিন্তা করে তৎকালীন বাংলার ছোটলাট জে.পি.গ্রান্ট পূর্ব বাংলা সফরে আসেন এবং নদীর ধারে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার নীলচাষীর করুণ অবস্থার কথা শুনে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর নীলচাষীদের করুন অবস্থা ও নীল বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানের জন্য নীল কমিশন গঠন করেন।
  • এই কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলায় জোর করে নীলচাষ বন্ধ হলে নীল বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

নীল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব-ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে সংঘটিত ব্রিটিশবিরোধী কৃষক বিদ্রোহগুলির মধ্যে বাংলার নীল বিদ্রোহ ছিল একমাত্র সফল বিদ্রোহ। বিভিন্ন দিক থেকে এই বিদ্রোহ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।যেমন-

  • নীল কমিশন গঠন-নীল বিদ্রোহের ফলে বাংলার ছোটলাট জে.পি.গ্রান্টের উদ্যোগে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর নীল কমিশন গঠিত হয়।এই কমিশনের রিপোর্ট থেকে নীল চাষীদের উপর নীলকর সাহেবদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কাহিনী সর্বসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ে।নীল কমিশন স্পষ্ট ভাষায় জানায় "নীলকর সাহেবদের ব্যবসা পদ্ধতি পাপজনক, ক্ষতিকারক ও ভ্রম সংকূল।"
  • অষ্টম আইন পাশ-কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে অষ্টম আইন পাশের দ্বারা "নীল চুক্তি আইন" রোধ করা হয়।এই আইনে বলা হয়, নীলচাষ সম্পূর্ণ ভাবে কৃষকের ইচ্ছাধীন।

ফরাসী বণিক লুই বােনাে ছিলেন ভারতের প্রথম নীলকর এবং ইংরেজ বণিক কাল ব্ল্যাম ভারতে প্রথম নীলশিল্প গড়ে তােলেন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীল উৎপাদন শুরু হলে ভারতে প্রায় নীলচাষ উঠে যায়।